ভাইরাস

ভাইরাস হলো একটি ল্যাটিন শব্দ যার অর্থ হলো 'বিষ' বা poison । ভাইরাস হলো এক প্রকারের জীবকণা যা কেবলমাত্র সজীব কোষেই নিজেদের অস্তিত্ব প্রকাশ করতে পারে। সজীব কোষের বাইরে এরা জড়ের ন্যায় আচরণ করে। 1898 খ্রিস্টাব্দে ডাচ্ বিজ্ঞানী বেইজেরিনক্ প্রথম ভাইরাস শব্দটি প্রবর্তন করেন।

Bigyanbook
ভাইরাস


ভাইরাস কাকে বলে?

নিউক্লীয় প্রোটিন দ্বারা নির্মিত, অতিক্ষুদ্র, অকোশীয়, রোগ সৃষ্টিকারী, পূর্ণ পরজীবী, কেবলমাত্র পোষককোশে প্রজননক্ষম, ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দৃশ্যমান জীব ও জড়ের মধ্যবর্তী পর্যায়ের বস্তুকে ভাইরাস বলে।


ভাইরাসের একক কী?

ভাইরাসের একক হলো ভিরিয়ন।


ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য

1. বিশুদ্ধ ভাইরাসকে কেলাস আকারে পাওয়া যায়। বিজ্ঞানী স্ট্যানলি TMV -কে কেলাস রূপে পরিশ্রুত করেছিলেন। কোষের ম্যাক্রো মলিকিউলগুলি কেলাস আকারে পাওয়া যায়, কিন্তু কোনো জীবকে কেলাস রূপে পরিশ্রুত করা যায় না।

2. কোশীয় ক্রিয়া-কলাপের জন্য ন্যূনতম 5000Å স্থান প্রয়োজন কিন্তু ভাইরাসের দৈর্ঘ্য 100Å-2000Å -এর বেশি হয় না।

3. একটি কোশ গঠনের দুটি অত্যাবশ্যক শর্ত হল, কোশ পর্দা এবং প্রোটোপ্লাজমের উপস্থিতি। ভাইরাসের ক্ষেত্রে এই দুটি কোশীয় উপাদান অনুপস্থিত থাকে।

4. ভাইরাসের দেহে বিপাক ক্রিয়া পরিচালনকারী সমস্ত কোষীয় অঙ্গানু অনুপস্থিত থাকে।

5. ভাইরাসের দেহে রেচন, শোষণ, বৃদ্ধি প্রভৃতি শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াগুলি লক্ষ্য করা যায় না।

6. ভাইরাসের দেহ জ্যামিতি তল বিশিষ্ট হয় যা কোনো সজীব দেহে লক্ষ্য করা যায় না।

7. অন্যান্য সজীব কোষ এর মতো ভাইরাস দেহেও নিউক্লিক অ্যাসিড উপস্থিত থাকে।

8. ভাইরাস পোষকদেহের মধ্যে বংশ বিস্তারে সক্ষম হয়।

9. ভাইরাস পোষকদেহের মধ্যে প্রবেশ করে রোগ সৃষ্টি করতে পারে। প্যাথোজেনেসিটি বা রোগ সৃষ্টির ক্ষমতা সজীব কোষের বৈশিষ্ট্য।

10. ভাইরাস পোষক দেহের রাইবোজোমকে ব্যবহার করে প্রোটিন সংশ্লেষণ করতে পারে।

11. ভাইরাস জিনোমের পরিব্যক্তি বা মিউটেশন সম্ভব যার মাধ্যমে ভাইরাস নিজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন করতে পারে।


ভাইরাসের জড় বৈশিষ্ট্য

উপরের বৈশিষ্ট্যের 1, 2, 3, 4, 5, 6 নং পয়েন্টগুলি দেখো।

ভাইরাসের সজীব বৈশিষ্ট্য

উপরের বৈশিষ্ট্যের 7, 8, 9, 10, 11 নং পয়েন্টগুলি দেখো।


ভাইরাসের শ্রেণীবিন্যাস

রোগ সংক্রমণ এবং বংশবিস্তারের ধারা অনুযায়ী ভাইরাসকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেগুলি হলো —

1. উদ্ভিদ ভাইরাস

এই ধরনের ভাইরাস উদ্ভিদকে আক্রমণ করে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে এবং উদ্ভিদ দেহে বংশবিস্তার করে। উদ্ভিদ ভাইরাস সাধারণত RNA যুক্ত হয়। যেমন — তামাক গাছের মোজেইক রোগ সৃষ্টিকারী - টোব্যাকো মোজেইক ভাইরাস (TMV), মটর গাছের মোজেইক রোগ সৃষ্টিকারী - PMV এবং বিন গাছের রোগ সৃষ্টিকারী - BMV ভাইরাস ইত্যাদি।


2. প্রাণী ভাইরাস

এই ধরনের ভাইরাস প্রাণীদের আক্রমণ করে বিভিন্ন ধরনের রোগ সৃষ্টি করে এবং প্রাণীদেহে বংশবিস্তার করে। প্রাণী ভাইরাস DNA যুক্ত এবং RNA যুক্ত দুই রকমেরই হয়। যেমন — মানুষের পোলিও রোগ সৃষ্টিকারী - পোলিও ভাইরাস (একতন্ত্রী RNA যুক্ত) , মানুষের স্মল পক্স সৃষ্টিকারী ভ্যারিওলা ভাইরাস (দ্বিতন্ত্রী DNA যুক্ত) ইত্যাদি।


3. ফাজ ভাইরাস

যে সমস্ত ভাইরাস ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণ করে এবং ব্যাকটেরিয়ার দেহে বংশবিস্তার করে তাদের ফাজ ভাইরাস বলে। যেমন — ব্যাকটেরিওফাজ ভাইরাস, E. coli ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে।


ভাইরাসগুলিকে তাদের নিউক্লিক অ্যাসিডের প্রকারের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ভাগে শ্রেণীবিন্যাস করা হয়, যা DNA বা RNA হতে পারে:

 ক্লাস I: দ্বিতন্ত্রী DNA (dsDNA) ভাইরাস।

 ক্লাস II: একতন্ত্রী DNA  (ssDNA) ভাইরাস।

 ক্লাস III: দ্বিতন্ত্রী RNA (dsRNA) ভাইরাস।

 ক্লাস IV: পজিটিভ-সেন্স একতন্ত্রী RNA (ssRNA) ভাইরাস।

 ক্লাস V: নেগেটিভ সেন্স একতন্ত্রী RNA (ssRNA) ভাইরাস।

 ক্লাস VI: RNA ভাইরাস যা বিপরীত প্রতিলিপি করে।

 ক্লাস VII: ডিএনএ ভাইরাস যা বিপরীত প্রতিলিপি করে।


ভাইরাসের অর্থনৈতিক গুরুত্ব

অপকারী ভূমিকা: ভাইরাস হলো বাধ্যতামূলক পরজীবী যার জন্যে ভাইরাস উদ্ভিদ ও প্রাণীদেহে বিভিন্ন প্রকারের রোগের সৃষ্টি করে।

উদ্ভিদ রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস —

টোব্যাকো মোজাইক ভাইরাস (TMV): টোব্যাকো মোজাইক ভাইরাস তামাক পাতায় মোজাইক রোগ সৃষ্টি করে। এই রোগের ফলে ক্লোরোফিল নষ্ট হয়ে যায় এবং পাতায় হালকা ও গাঢ় সবুজ বর্ণের ছোপ বা দাগ দেখা যায়।

আলুর লিফ্ রোল ভাইরাস (LRV): আলুগাছ এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে, গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং গাছের পাতাগুলি কিনারা বরাবর গুটিয়ে যায়।

টুংরো ভাইরাস: ধানগাছ এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে ধানগাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, পাতা বর্ণহীন এবং পচনশীল প্রকৃতির হয়। এই ভাইরাসের আক্রমণের ফলে ধানের শীষগুলি ছোটো ও কম এবং হালকা দানাযুক্ত হয়। ধানের টুংরো ব্যাসিলিফর্ম ভাইরাস (RTBV) এবং টুংরো স্ফেরিকাল ভাইরাস (RTSV) এই রোগলক্ষণ সৃষ্টি করে।

প্রাণী এবং মানবদেহে রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস —

অ্যাডিনো ভাইরাস সর্দিজ্বর সৃষ্টি করে, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস ফ্লু সৃষ্টি করে, পক্সভিরিডি বা পক্স ভাইরাস বসন্তরোগ সৃষ্টি করে,হরপিসভিরিডি (HHV-1 ও HHV-2) মানুষের হারপিস রোগ সৃষ্টি করে, হেপাডনাভিরিডি বা হেপাটাইটিস ভাইরাস যকৃতের রোগ সৃষ্টি করে যা হেপাটাইটিস নামে পরিচিত। এছাড়াও HIV-1, HIV-2 (Human Immuno Deficiency Virus) ভাইরাস AIDS (Acquired Immuno Deficiency Syndrome) নামক প্রাণঘাতী রোগ সৃষ্টি করে।


উপকারী ভূমিকা:

1. জিনগত গবেষণা: ভাইরাস জিনোম হলো জিনগত গবেষণার এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। ফাজ ভাইরাস ট্রান্সডাকশন পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়ায় নতুন বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটায়।

2. ভ্যাকসিন উৎপাদন: বিভিন্ন ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করে ভ্যাকসিন হিসেবে মানবদেহে প্রবেশ করনো হয়। এই ভ্যাকসিন রক্তে অ্যান্টিবডি উৎপাদন করে এবং ভিরুলেন্ট বা রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের বিরুদ্ধে অনাক্রম্যতা প্রদান করে। জলাতঙ্ক, গুটি বসন্ত, পোলিও প্রভৃতি রোগের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করা হয়।

3. ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ দমন: সুনির্দিষ্ট ফাজ ভাইরাস ব্যবহার করে রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করা যায়।

4. জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং: আকাঙ্ক্ষিত জিন বা DNA -এর খন্ড তুলনামূলকভাবে ছোটো হলে, ফাজ ভাইরাসের DNA -এর সঙ্গে ওই DNA খন্ডকে যুক্ত করে ব্যাকটেরিয়াতে প্রবেশ করানো হয়। এই ক্ষেত্রে ফাজ ভাইরাস জিন বহনকারী কণা বা ভেক্টর হিসেবে কাজ করে।

5. পতঙ্গনাশক ভাইরাস: আলফা আলফা ক্যাটারপিলার NPV, ক্যাবেজ ওয়ার্ম GIV প্রভৃতি ভাইরাসগুলি পতঙ্গ ও তাদের শুককীট ও মুককীট দমনে প্রয়োগ করা হয়। ভাইরন H, VTN, বায়োট্রল প্রভৃতি হলো কীটনাশক বা পতঙ্গনাশক ভাইরাসের বাণিজ্যিক নাম।


উদ্ভিদ ভাইরাস কাকে বলে?

যেসব ভাইরাস উদ্ভিদ দেহে বংশবিস্তার করে এবং রোগ সৃষ্টিকরে, তাদের উদ্ভিদ ভাইরাস বলে। উদাহরণ - টোব্যাকো মোজেইক ভাইরাস বা TMV, বিন মোজেইক ভাইরাস বা BMV ইত্যাদি।


প্রাণী ভাইরাস কাকে বলে?

যেসব ভাইরাস প্রাণীদেহে বংশবিস্তার করে এবং রোগ সৃষ্টিকরে তাদের প্রাণী ভাইরাস বলে। উদাহরণ - বসন্ত ভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, পোলিও ভাইরাস, করোনা ভাইরাস ইত্যাদি।


উদ্ভিদ ও প্রাণী ভাইরাসের পার্থক্য

উদ্ভিদ ভাইরাস প্রাণী ভাইরাস
1. এদের দেহের বাইরের আবরণ হলো ক্যাপসিড। 1. এদের ক্যাপসিডের বাইরে পেলপোমিয়ার নামক একটি অতিরিক্ত আবরণী থাকে।
2. উদ্ভিদ ভাইরাসের নিউক্লিক অ্যাসিড প্রধানত RNA । 2. প্রাণী ভাইরাসের নিউক্লিক অ্যাসিড প্রধানত DNA , কতিপয় প্রাণী ভাইরাসে RNA থাকে।
3. এদের RNA একতন্ত্রী এবং রৈখিক প্রকৃতির হয়। 3. এদের DNA দ্বিতন্ত্রী, চক্রাকার বা রৈখিক প্রকৃতির হয়।
4. উদ্ভিদ ভাইরাস পত্ররন্ধ্র এবং অন্যান্য ক্ষতস্থান দিয়ে পোষক কোশে প্রবেশ করে। 4. এরা পোষক দেহে ক্ষত সৃষ্টি করে প্রবেশ করে।


❤️ from Bigyanbook

1 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
নবীনতর পূর্বতন