ব্যাকটেরিয়া

ব্যাকটেরিয়া জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে সর্বত্রই বিচরণ করে। সমুদ্র ও মৃত্তিকার গভীরতম স্তরে এবং উচ্চতম পর্বত শৃঙ্গে এরা বিচরণ করে। এরা অক্সিজেনবিহীন পরিবেশেও বেঁচে থাকতে পারে।

ব্যাকটেরিয়া
ব্যাকটেরিয়া


ব্যাকটেরিয়া কাকে বলে?

আদি নিউক্লিয়াসযুক্ত, কোষপ্রাচীর সমন্বিত, এককোষী, ক্ষুদ্রতম, সরল প্রকৃতির আণুবীক্ষণিক জীবদের ব্যাকটেরিয়া বলে।


ব্যাকটেরিয়ার বৈশিষ্ট্য

1. কোশীয় জীবদের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া হলো ক্ষুদ্রতম এবং সরলতম আণুবীক্ষণিক জীব। এদের দৈর্ঘ্য 0.15μm থেকে 80μm পর্যন্ত হয়।

2. ব্যাকটেরিয়ার কোশ পর্দার বাইরে স্থূল এবং জড় কোশপ্রাচীর উপস্থিত যা পেপটাইডোগ্লাইকেন দিয়ে গঠিত।

3. অধিকাংশ ব্যাকটেরিয়ার কোশপ্রাচীরের বাইরে একটি পিচ্ছিল স্লাইম স্তর থাকে। এই স্তরটি অনেকক্ষেত্রে শক্ত হয়ে ক্যাপসুল গঠন করে।

4. প্রোটোপ্লাজম 7-8nm পুরু প্রোটিন ও লিপিড স্তর দিয়ে গঠিত কোষ পর্দা দিয়ে আবৃত হয়। গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ায় কোশপ্রাচীরের বাইরে একটি অতিরিক্ত কোষ পর্দা থাকে যাকে বহিঃপর্দা বলে।

5. কোশ পর্দা কোনো কোনো স্থানে ভাঁজযুক্ত হয়ে মেসোজোম গঠন করে।

6. বহিরাকৃতির ভিত্তিতে ব্যাকটেরিয়া গোলাকার বা কক্কাস (Micrococcus), দন্ডাকার বা ব্যাসিলাস (Lactobacillus), সর্পিলাকার বা স্পাইরিলাম (Spirillum), কমা আকৃতির বা ভিব্রিও (Vibrio) প্রকৃতির হয়।

7. ব্যাকটেরিয়ায় বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি লক্ষ্য করা যায়। Chlorobium জাতীয় ব্যাকটেরিয়া সালোকসংশ্লেষকারী বা ফটো অটোট্রপ (Photo autotroph), Nitrosomonas রাসায়নিক পদার্থ থেকে শক্তি সংগ্রহ করে অর্থাৎ কেমো অটোট্রফ (Chemoautotroph)। এছাড়া ব্যাকটেরিয়া মৃতজীবী (Clostridium), পরজীবী (Niseria) বা মিথোজীবী (Rhizobium) প্রকৃতির হয়।

8. সালোকসংশ্লেষকারী ব্যাকটেরিয়ার সাইটোপ্লাজমে একক পর্দা বেষ্টিত চ্যাপ্টা থলির ন্যায় ল্যামেলি বা গোলাকার ভেসিকেল (Lamellae or vesicle) থাকে। এই অঙ্গানুর মধ্যে সালোকসংশ্লেষকারী রঞ্জক বা ব্যাকটেরিওক্লোরোফিল (bacteriochlorophyll) থাকে।

9. সাইটোপ্লাজমে একক পর্দা বৃত সমস্ত কোষীয় অঙ্গানু (মাইটোকনড্রিয়া, এন্ডোপ্লাজমীয় জালিকা প্রভৃতি) অনুপস্থিত। রাইবোজোম 70S প্রকৃতির যার দুটি অধঃএকক 30S ও 50S প্রকৃতির হয়।

10. প্রজাতিভেদে ব্যাকটেরিয়া অবাত বা সবাত শ্বসন সম্পন্ন করে অর্থাৎ এরা অবায়ুজীবী বা বায়ুজীবী প্রকৃতির হয়।

11. প্রোক্যারিওট হওয়ায় ব্যাকটেরিয়ায় সুনির্দিষ্ট নিউক্লিয়াস থাকে না। প্রোটোপ্লাজম এর মধ্যে সচরাচর একটি দ্বিতন্ত্রী চক্রাকার DNA থাকে। ব্যাকটেরিয়ার এই জেনেটিক পদার্থ কে নিউক্লিয়য়েড (Nucleoid) বা জিনোফোর (Genophore) বলে। এই অত্যাবশ্যক DNA ছাড়াও ব্যাকটেরিয়ায় এক বা একাধিক, স্বাধীনভাবে প্রতিলিপি গঠনে সক্ষম, ক্ষুদ্র চক্রাকার DNA থাকে যাদের প্লাসমিড (Plasmid) বলে।

12. ক্রোমোজোম ও বেম তন্তু গঠন করতে পারে না বলে ব্যাকটেরিয়া অ্যামাইটোসিস (Amitosis) পদ্ধতিতে বিভাজিত হয়।

13. ব্যাকটেরিয়া প্রধানত অনুপ্রস্থ দ্বিবিভাজন (Transverse binary fission) পদ্ধতিতে অযৌন জনন সম্পন্ন করে। এছাড়া কোরকোদগম প্রক্রিয়ায় (Budding) এবং সূত্রাকার ব্যাকটেরিয়ায় খন্ডীভবন (Fragmentation) পদ্ধতিতেও অযৌন জনন সম্পন্ন করতে পারে। অন্তরেণু (endospore) গঠন ব্যাকটেরিয়ার বিশেষ প্রজনন প্রক্রিয়া।

14. মিয়োসিস ও গ্যামেট উৎপাদন অনুপস্থিত বলে ব্যাকটেরিয়ার যৌন জনন অনুপস্থিত। তবে সংযুক্তি বা সংশ্লেষ (Conjugation), রূপান্তর ভবন (Transformation) এবং ট্রান্সডাকশন (Transduction) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জিনের পুনঃসংযোজন ঘটে।

15. ব্যাকটেরিয়া বিভিন্ন পরিবেশে বসবাস করতে সক্ষম। বিভিন্ন তাপমাত্রার ভিত্তিতে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়াকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যেগুলি হলো — (A) সাইক্রোফিলস (Psychrophiles) : নিম্ন তাপমাত্রায় বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া। (B) মেসোফিলস (Mesophiles) : সাধারণ তাপমাত্রায় বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া। (C) থার্মোফিলস (Thermophiles) : উচ্চ তাপমাত্রায় বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া। আম্লিক মাধ্যমে যে ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি পায় তাদের অ্যাসিডোফিলস (Acidophiles) বলে। ক্ষারীয় মাধ্যমে উৎপন্ন ব্যাকটেরিয়াকে অ্যালকালোফিলস (Alkalophiles) বলে। লবণাক্ত মাধ্যমে উৎপন্ন ব্যাকটেরিয়াকে হ্যালোফিলস (Halophiles) বলে।


গ্ৰাম পজিটিভ ব্যাকটেরিয়া কাকে বলে?

যে ব্যাকটেরিয়া ক্রিস্টাল ভায়োলেট আয়োডিনের বেগুনী বর্ণ স্থায়ীভাবে ধরে রাখে অর্থাৎ অ্যালকোহল জাতীয় বিরঞ্জকে ধুয়ে যায় না তাকে গ্ৰাম পজিটিভ ব্যাকটেরিয়া বলে।


গ্ৰাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া কাকে বলে?

যে ব্যাকটেরিয়ার বেগুনী বর্ণ অ্যালকোহলে ধুয়ে যাওয়ার ফলে পরবর্তী রঞ্জক স্যাফ্রানিন এর লাল বর্ণ ধারণ করে তাকে গ্ৰাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া বলে।


গ্ৰাম পজিটিভ ও গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার পার্থক্য

গ্ৰাম পজিটিভ গ্রাম নেগেটিভ
1. অ্যালকোহল দ্বারা ক্রিস্টাল ভায়োলেট আয়োডিন এর বর্ণ বিধৌত হয় না বলে ব্যাকটেরিয়া প্রতিরঞ্জকের বর্ণ ধারণ করে না অর্থাৎ, বেগুনী বর্ণ ধারণ করে। 1. অ্যালকোহলে ক্রিস্টাল ভায়োলেটের রং ধুয়ে যাওয়ায় প্রতিরঞ্জকের লাল বর্ণ ধারণ করে।
2. এই ব্যাকটেরিয়ার কোশ প্রাচীর অধিক পুরু হয় (25-80 nm পুরু)। 2. এই ব্যাকটেরিয়ার কোশ প্রাচীর পাতলা হয় (10-15 nm পুরু)।
3. এই ব্যাকটেরিয়ায় পেপটাইডোগ্লাইকানের পরিমাণ বেশি থাকে, কোশের শুষ্ক ওজনের 20-30% । 3. এই ব্যাকটেরিয়ায় পেপটাইডোগ্লাইকানের পরিমাণ কম থাকে, কোশের শুষ্ক ওজনের 10-20% ।
4. টিকোয়িক অ্যাসিড উপস্থিত। 4. টিকোয়িক অ্যাসিড অনুপস্থিত।
5. টিকোরনিক অ্যাসিড উপস্থিত। 5. টিকোরনিক অ্যাসিড অনুপস্থিত।
6. এই ব্যাকটেরিয়ায় লিপিডের পরিমাণ অত্যন্ত কম (0-2%) । 6. এই ব্যাকটেরিয়ায় লিপিডের পরিমাণ বেশি (10-20%) ।
7. কোশপর্দা এক স্তর বিশিষ্ট, কোষপ্রাচীরের ভিতরের দিকে থাকে। 7. কোশপর্দা ছাড়াও কোষপ্রাচীরের বাইরের দিকে একটি অতিরিক্ত বহিঃপর্দা থাকে।
8. পেরিপ্লাজমিক স্থান অনুপস্থিত। 8. বহিঃ ও অন্তঃপর্দার মধ্যবর্তী স্থানকে পেরিপ্লাজমিক স্থান বলে। পেরিপ্লাজমিক স্থান উপস্থিত।
9. এই ব্যাকটেরিয়ার অধিবিষ বহিঃকোশীয় প্রকৃতির হয়। 9. এই ব্যাকটেরিয়ার অধিবিষ অন্তঃকোশীয় প্রকৃতির হয়।
10. শুষ্কতা প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। 10. শুষ্কতা প্রতিরোধ ক্ষমতা কম।
11. অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি সংবেদনশীল। যেমন, পেনিসিলিন এর প্রতি সংবেদনশীল, কারণ, পেনিসিলিন পেপটাইডোগ্লাইকান স্তরকে বিনষ্ট করে। 11. অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি কম সংবেদনশীল। যেমন, পেনিসিলিন এর প্রতি কম সংবেদনশীল।
12. ফ্ল্যাজেলার বেসাল দানায় ভিতরের চাকতি জোড়া (M ও S) উপস্থিত। 12. ফ্ল্যাজেলার বেসাল দানায় বাইরে ও ভিতরে (P, L এবং M, S) দুজোড়া চাকতি থাকে।
13. পিলি অনুপস্থিত। 13. পিলি উপস্থিত।
14. মেসোজোম উপস্থিত। 14. মেসোজোম অনুপস্থিত।
15. অধিকাংশ প্রজাতিই অন্তঃরেণু গঠন করে। 15. অন্তঃরেণু গঠন করে না।
16. অনেক প্রজাতি কোরকোদগম পদ্ধতির মাধ্যমে প্রজনন করে। 16. কোরকোদগম দেখা যায় না।


সংশ্লেষ কাকে বলে?

যে পদ্ধতিতে বিপরীত যৌনতাসম্পন্ন দুটি ব্যাকটেরিয়া পরস্পরের সংস্পর্শে আসার পর দাতা কোশের DNA বা জিনোমের একটি অংশ গ্ৰহীতা কোশে স্থানান্তরিত হবার ফলে নতুন প্রজননিক প্রকরণযুক্ত ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্টি হয়, তাকে সংশ্লেষ বা সংযুক্তি বলে।


রূপান্তরভবন কাকে বলে?

যে পদ্ধতিতে দাতা কোশ থেকে নির্গত দ্বিতন্ত্রী DNA অণুর একটি অংশ বহিঃকোশীয় মাধ্যমের সাহায্যে গ্ৰহীতা কোশে প্রবেশ করে গ্ৰহীতা কোশের DNA অণুর সঙ্গে পুনঃসংযোজন করে নতুন বৈশিষ্ট্যের সূচনা করে, তাকে রূপান্তরভবন বা ট্রান্সফরমেশন বলে।


ট্রান্সডাকশন কাকে বলে?

ব্যাকটেরিয়ার যে পুনঃসংযোজন প্রক্রিয়ায় দাতা কোশের DNA অণুর একটি অংশ ব্যাকটেরিওফাজের মাধ্যমে গ্ৰহীতা কোশে স্থানান্তরিত হয়ে প্রজননিক প্রকরণযুক্ত অপত্য কোশের (recombinant cell) সৃষ্টি করে, তাকে ট্রান্সডাকশন বলে।


সংশ্লেষ ও রূপান্তরভবনের পার্থক্য

সংশ্লেষ রূপান্তরভবন
1. এই পদ্ধতির জন্য দৈহিক সংযুক্তি আবশ্যক। 1. এই পদ্ধতির জন্য দৈহিক সংযুক্তির আবশ্যকতা নেই।
2. দুটি সজীব ব্যাকটেরিয়ার (দাতা ও গ্রহীতা) মধ্যে সংযুক্তি ঘটে। 2. একটি সজীব এবং একটি মৃত বা জীবিত ব্যাকটেরিয়ার দেহ থেকে পরিস্রুত DNA -এর মধ্যে রূপান্তর ভবন ঘটে।
3. দাতা এবং গ্রহীতা ব্যাকটেরিয়ার দৈহিক মিলনের সময় সংযুক্তি নালি সৃষ্টি হয়। এই নালী পথে দাতার প্লাসমিড DNA -এর প্রতিলিপি গ্রহীতা কোষে প্রবেশ করে। 3. সজীব ব্যাকটেরিয়া পরিস্রুত DNA শোষণ করে।
4. এটি অপেক্ষাকৃত উন্নত জনন প্রক্রিয়া। 4. এটি অনুন্নত জনন প্রক্রিয়া।


ট্রান্সফরমেশন ও ট্রান্সডাকশনের পার্থক্য

ট্রান্সফরমেশন ট্রান্সডাকশন
1. একটি সজীব এবং একটি মৃত বা জীবিত ব্যাকটেরিয়ার দেহ থেকে পরিস্রুত DNA -এর মধ্যে ট্রান্সফরমেশন ঘটে। 1. একটি ব্যাকটেরিওফাজ এবং দুটি সজীব ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ট্রান্সডাকশন সম্পন্ন হয়।
2. সজীব ব্যাকটেরিয়া পরিস্রুত DNA শোষণ করে। 2. ফাজের সাহায্যে বাহিত DNA এর একটি অংশ ব্যাকটেরিয়ার DNA এর সঙ্গে মিলিত হয়।
3. এটি অনুন্নত জনন প্রক্রিয়া। 3. এটি অপেক্ষাকৃত উন্নত জনন প্রক্রিয়া।


❤️ from Bigyanbook

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন