বায়ুমণ্ডল কাকে বলে ?
উত্তর: ভূপৃষ্ঠের যে অদৃশ্য গ্যাসীয় আবরণ, অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা ও জলীয়বাষ্প পৃথিবীকে বেষ্টন করে আছে তাকে বায়ুমণ্ডল বলে।
বায়ুমণ্ডলের স্তরবিন্যাস
রাসায়নিক গঠন বা উপাদানের তারতম্যের উপর ভিত্তি করে বায়ুমণ্ডল কে দুটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে। এই স্তর দুটি হলো —
- হোমোস্ফিয়ার বা সমমন্ডল
- হেটেরোস্ফিয়ার বা বিষম মন্ডল।
উষ্ণতা তারতম্যের উপর ভিত্তি করে বায়ুমণ্ডলকে ছয়টি স্তরে ভাগ করা হয়, যেগুলি হলো —
- ট্রপোস্ফিয়ার
- স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার
- মেসোস্ফিয়ার
- থার্মোস্ফিয়ার
- এক্সোস্ফিয়ার
- ম্যাগনেটোস্ফিয়ার।
1) ট্রপোস্ফিয়ার
গ্রিক শব্দ 'Tropos' বা 'Mixing' যার অর্থ মিশে যাওয়া এবং 'Sphere' যার অর্থ অঞ্চল বা মন্ডল। এর থেকেই এই স্তরের নামকরণ হয়েছে ট্রপোস্ফিয়ার। ট্রপোস্ফিয়ার হলেও বায়ুমন্ডলের সবথেকে নিম্নতম স্তর।
ভূপৃষ্ঠ থেকে ট্রপোস্ফিয়ারের উচ্চতা নিরক্ষীয় অঞ্চলে ১৮ কিলোমিটার এবং দুই মেরু অঞ্চলে ৮ কিলোমিটার।
ট্রপোস্ফিয়ারের বৈশিষ্ট্য :
i) এই স্তরের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রতি কিমি উচ্চতায় উষ্ণতা কমতে থাকে। ৬.৪° সেলসিয়াস হারে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উষ্ণতা হ্রাস পায়। একে নরমাল ল্যাপসরেট বা স্বাভাবিক উষ্ণতা হ্রাসের বিধি বলে।
ii) নিরক্ষীয় অঞ্চলে ট্রপোস্ফিয়ারের অর্ধাংশে উষ্ণতা থাকে -৮০° সেলসিয়াস এবং মধ্য অক্ষাংশে -৫৮° সেলসিয়াস।
iii) মোট গ্যাসীয় ভরের ৭৫ শতাংশ রয়েছে ট্রপোস্ফিয়ারে। কেবলমাত্র ট্রপোস্ফিয়ারে জলীয়বাষ্প, ধূলিকণা ও মেঘ রয়েছে বলেই আবহাওয়া ও জলবায়ুর যাবতীয় ঘটনা এই স্তরেই ঘটে থাকে। এই কারণে এই স্তরকে "ক্ষুব্ধ মন্ডল" বলে।
iv) বায়ু দূষণকারী প্রায় সমস্ত পদার্থই এই স্তরে অবস্থান করে।
v) ট্রপোস্ফিয়ারে দুই কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত ভূপ্রকৃতি বায়ুকে বাধা দেয় বলে, বায়ুর গতিবেগ কম হয় কিন্তু তারপর গতিবেগ ক্রমশ বাড়তে থাকে।
ট্রপোপজ কাকে বলে?
উত্তর: ট্রপোস্ফিয়ারের ঊর্ধ্বে প্রায় তিন কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত উষ্ণতার হ্রাস অথবা বৃদ্ধি কোনটাই ঘটে না। একে ট্রপোপজ বলে।
এই অংশের ক্ষেত্রে উচ্চতা বৃদ্ধি পেলেও উষ্ণতা অপরিবর্তিত থাকে। তাই এই অঞ্চলকে সমতাপ অঞ্চল (Isothermal zone) বলে।
2) স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার
ট্রপোপজের উর্ধ্বে ৫০ কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল কে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার বলে।
স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের বৈশিষ্ট্য :
i) এই স্তরের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়। ট্রপোপজে যেখানে উষ্ণতা থাকে -৮০° সেলসিয়াস, সেখানে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের উর্ধ্বে উষ্ণতা বেড়ে হয় ৪° সেলসিয়াস।
ii) স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের উদ্ধাংশে ওজোন গ্যাসের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি বলে এই স্তরকে ওজোন স্তর বলে। ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি এই স্তরেই শোষিত হয় বলেই এই অংশে উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়।
iii) এই স্তরে বায়ুপ্রবাহ, জলীয় বাষ্প, মেঘ প্রভৃতি থাকে না বলে একে "শান্ত মণ্ডল" বলে। দ্রুতগামী জেট প্লেনগুলি এই স্তর দিয়েই যাতায়াত করে।
স্ট্র্যাটোপজ কাকে বলে?
উত্তর: স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের উদ্ধাংশে কিছু দূর পর্যন্ত উষ্ণতা বাড়েও না এবং কমেও না। এই অংশকে স্ট্র্যাটোপজ বলে।
3) মেসোস্ফিয়ার
স্ট্র্যাটোপজ এর উর্ধ্বে ৮০ কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত অংশকে মেসোস্ফিয়ার বলে।
মেসোস্ফিয়ারের বৈশিষ্ট্য :
i) এই স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উষ্ণতা হ্রাস পায়।
ii) এই অংশে বায়ুর চাপও অনেক কম থাকে।
iii) উল্কাপিণ্ড এই স্তরেই পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
iv) বায়ুর প্রবল ঊর্ধ্বগামী পরিচলন স্রোতের প্রভাবে এই স্তরে জলীয়বাষ্প প্রবেশ করে অতি হালকা মেঘের সৃষ্টি করে।
মেসোপজ কাকে বলে?
উত্তর: মেসোস্ফিয়ারের উর্ধাংশে কিছু দূর পর্যন্ত উচ্চতায় উষ্ণতার কোনোরূপ পরিবর্তন হয় না একে মেসোপজ বলে।
4) থার্মোস্ফিয়ার বা আয়নোস্ফিয়ার
মেসোপজ এর উর্ধাংশে ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল কে থার্মোস্ফিয়ার বা আয়োনোস্ফিয়ার বলে। এই স্তরের নিচের অংশের বায়ু আয়নিত অবস্থায় থাকে।
থার্মোস্ফিয়ারের বৈশিষ্ট্য :
i) থার্মোস্ফিয়ারে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উষ্ণতা অতি দ্রুত হারে বৃদ্ধি পায় এবং ৫০০ কিলোমিটার উচ্চতায় উষ্ণতা বেড়ে প্রায় ১২০০° সেলসিয়াস হয়। এখানে বায়ুর ঘনত্ব অত্যন্ত কম হয় এবং বায়ুমণ্ডল প্রধানত আণবিক এবং পারমাণবিক নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন দ্বারা গঠিত বলে অতিবেগুনি এবং এক্স-রে রশ্মি এই স্তরে শোষিত হয়। এর ফলে উষ্ণতা এই স্তরে অতি দ্রুত হারে বাড়তে থাকে।
ii) সূর্য থেকে আগত এক্স-রে রশ্মি, গামা রশ্মি, অতিবেগুনি রশ্মি প্রভৃতি বায়ুমন্ডলের পরমাণু ভেঙে ঋণাত্মক ইলেকট্রনের বহিষ্কার এবং ধনাত্মক বস্তু কণা সৃষ্টি করে। তাই এই স্তরের নাম আয়োনোস্ফিয়ার।
iii) বস্তু কণা এই স্তরে আয়নিত অবস্থায় থাকে বলে বেতার তরঙ্গ এই স্তর থেকেই পুনরায় পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে।
iv) এই স্তরে বায়ু কণা পরমাণুতে পরিণত হয় এবং শক্তিশালী ইলেকট্রন ও প্রোটনের সংস্পর্শে এক ধরনের আলোকরশ্মি বেরিয়ে আসে। সুমেরুতে এই আলোকরশ্মি অররা বেরিওলিস বা সুমেরু প্রভা এবং কুমেরুতে এই আলোকরশ্মি অরোরা অস্ট্রিয়ালিস বা কুমেরু প্রভা নামে পরিচিত।
5) এক্সোস্ফিয়ার
আয়োনোস্ফিয়ারের ঊর্ধাংশে ৫০০ থেকে ৭৫০ কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে এই স্তর।
এক্সোস্ফিয়ারের বৈশিষ্ট্য :
i) এই স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উষ্ণতা বৃদ্ধি পায় (১২০০° - ১৬০০° সেলসিয়াস)।
ii) এই স্তরে হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম গ্যাসের প্রাধান্য বেশি থাকে।
6) ম্যাগনেটোস্ফিয়ার
এক্সোস্ফিয়ার এর ঊর্ধাংশকে ম্যাগনেটোস্ফিয়ার বলে। এই স্তর হল বায়ুমন্ডলের ঊর্ধ্বততম স্তর এবং পৃথিবীর শেষ সীমা। ইলেকট্রন ও প্রোটন দ্বারা গঠিত চৌম্বক ক্ষেত্র বায়ুমণ্ডল কে বেষ্টন করে আছে বলেই এই স্তরকে ম্যাগনেটোস্ফিয়ার বলা হয়।
প্রশ্ন-উত্তর
উল্কাপিণ্ড পুড়ে ছাই হয়ে যায় কোন স্তরে ?
উত্তর: মেসোস্ফিয়ারে উল্কাপিণ্ড পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
উষ্ণতার তারতম্যের উপর ভিত্তি করে বায়ুমন্ডল কে কয় ভাগে ভাগ করা যায় ও কি কি?
উত্তর: উষ্ণতা তারতম্যের উপর ভিত্তি করে বায়ুমণ্ডল কে ছটি স্তরে ভাগ করা হয় যেগুলি হলো ট্রপোস্ফিয়ার, স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার, মেসোস্ফিয়ার, থার্মোস্ফিয়ার, এক্সোস্ফিয়ার এবং ম্যাগনেটোস্ফিয়ার।
রাসায়নিক গঠনের উপর ভিত্তি করে বায়ুমণ্ডল কে কয় ভাগে ভাগ করা যায় ও কি কি?
উত্তর: রাসায়নিক গঠনের উপর ভিত্তি করে বায়ুমন্ডল কে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। হোমোস্ফিয়ার বা সমমন্ডল এবং হেটেরোস্ফিয়ার বা বিষম মন্ডল।
হোমোস্ফিয়ার কাকে বলে?
উত্তর: বায়ুমণ্ডলের উপাদান গুলির অনুপাত যে স্তরে মোটামুটি একই রকম থাকে তাকে হোমোস্ফিয়ার বলে।
হেটেরোস্ফিয়ার কাকে বলে?
উত্তর: বায়ুমণ্ডলের উপাদানগুলির অনুবাদ যে স্তরে একই রকম থাকে না তাকে হেটেরোস্ফিয়ার বলে।
হেটেরোস্ফিয়ার কয়টি স্তরে বিভক্ত?
উত্তর: হেটেরোস্ফিয়ার প্রধানত চারটি স্তরে বিভক্ত। যেগুলি হলো, (১) আণবিক নাইট্রোজেন স্তর (৮৮-২০০ কিমি), (২) পারমাণবিক অক্সিজেন স্তর (২০০-১১২০ কিমি), (৩) হিলিয়াম স্তর (১১২০-৩৫৪০ কিমি) এবং (৪) হাইড্রোজেন স্তর (৩৫৪০-১০০০০ কিমি)।